লিখতে হলে পড়তে হবে
আলতাফ শাহনেওয়াজ | তারিখ: ০৩-০২-২০১৩
লেখক হওয়ার উপায় কী? শুধু কি কালি-কলম-মন দিয়েই লেখা যায়? নাকি আরও কিছু লাগে? যারা লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তারা নিশ্চয় এই প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজে ফিরছ...
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করতেন, যদি আজকের দিনই হয় আমার জীবনের শেষ দিন, তাহলে আমার কোন কাজটি সবার আগে করা উচিত? একজন লেখকও এ রকমভাবে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেন শব্দে শব্দে—কী লিখতে চান তিনি, কীভাবে লিখতে চান, কী কথাই বা বলতে চান? অমর একুশে বইমেলার বই-গন্ধ গায়ে মেখে তোমরা যারা লেখক হওয়ার পথ খুঁজছ, যারা স্বপ্ন দেখছ ভবিষ্যতের লেখক হওয়ার, তারা তো জানোই শব্দে শব্দে মিল-অমিল দিয়ে লেখক হওয়া এত সহজ কম্ম নয়। এর জন্যও লাগে দীর্ঘ প্রস্তুতি, পড়াশোনা। তোমাদের জন্য দেশের তিন খ্যাতিমান লেখক এবার জানাচ্ছেন কেন লেখক হলেন তাঁরা, কীভাবে লেখক হলেন—অভিজ্ঞতার আদ্যপান্ত।
হাসান আজিজুল হক
লিখতে হলে পড়তে হবে—তরুণ লেখকদের প্রতি প্রথমত এটিই আমার বলার কথা। মনে রাখতে হবে, লেখকের পথ বড়ই বিপদসংকুল। এটা সম্পূর্ণ একার পথ। কঠিন এক সাধনা। কোনো লেখকের পক্ষে কি বলা সম্ভব, তিনি কেন লেখক হয়েছেন? মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, লেখক না হয়ে উপায় ছিল না বলেই শেষ পর্যন্ত লেখক হয়েছি। খুব ছোটবেলা থেকে কেন যে কবিতা, গল্প—এসব লিখতাম, আজ সেটা স্মৃতি খুঁড়ে বের করা কঠিন। বলা যায়, যে পৃথিবীতে বেঁচে আছি সেই পৃথিবীর একটা অর্থ ও ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারি লেখার মাধ্যমে। এটি হয়তো প্রত্যেক লেখকই পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে একজন লেখকের সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট একটা ধারণা থাকা জরুরি। লেখক হতে চাইলে তুমি যা কিছু করতে চাও, তার সবই তোমাকে লেখার ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত করতে হবে। ব্যক্তি ভেদে একেকজন লেখকের লেখার কৌশল একেক রকম। আমি যেমন সাধারণত একটি লেখা একবারেই লিখে ফেলি। কিন্তু লেখাটি লেখার আগে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা থাকে বিস্তর। কীভাবে আগের লেখা থেকে নতুন লেখাকে আলাদা করা যায়—এই ভাবনাও থাকে। আমি মনে করি, প্রত্যেক লেখকই তাঁর নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেন একান্ত তাঁর মতো করে।
মহাদেব সাহা
আমি কি কবি হতে পেরেছি? জানি না। মনে পড়ে, ১৯৭৬ সালে প্রেসক্লাব-সংলগ্ন ফুটপাতের ওপর বসে একটানে লিখেছিলাম ‘চিঠি দিও’ কবিতাটি। পরে সেটি প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়। শৈশবে আমার মা বিরাজমোহিনির মুখে রামায়ণ ও মহাভারত শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তখন মনে হতো, বাল্মীকি বা ব্যাসদেবের মতো যদি কবি হতে পারতাম!
একটি শব্দের জন্য বসে থেকেছি সারা রাত। জীবনানন্দ দাশ কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা পড়েছি উন্মাদের মতো। পড়েছি জন কিটস, রাইনার মারিয়া রিলকে, ডব্লিউ বি ইয়েটস। পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে হয়তো কবি হয়ে উঠেছি আমি। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে কবি হচ্ছে একমাত্র অবিনাশী সত্তা—রাজা, সম্রাট তাঁর কাছে কিছু নয়। তাই কবি বা লেখক হতে গেলে যেমন পড়াশোনা জরুরি, তেমনি দরকার লেখকের স্বাধীন সত্তা। কারও পরামর্শ নিয়ে কেউ কোনো দিন কবি হতে পারে না।
অদিতি ফাল্গুনী
যদি মেয়ে না হতাম, তাহলে আমি হয়তো কখনোই লেখক হতাম না। কথাটি খোলাসা করি—মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী সংকুচিত হয়েছে। সেই শৈশব উত্তীর্ণকালে আমার বয়সী বন্ধুগোত্রীয় ছেলেরা যেভাবে পৃথিবীকে দেখেছে, আমার দেখা ছিল তাঁদের থেকে ভিন্ন। শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী যে ছোট হয়ে এল, এই বেদনাবোধই আমাকে লেখক করে তুলেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, প্রতিকূলতা অনেক সময় আমাদের ভেতরের আগুনকে উসকে দেয়।
আমাদের বাড়িতে বড় একটি পাঠাগার ছিল। সেখানে ছিল রুশ সাহিত্যসহ নানা ধরনের বই। এ ছাড়া কলেজের গ্রন্থাগারে পড়েছি গ্রিক নাটক। এই পাঠ আমাকে পুষ্টি দিয়েছে। একসময় পাহাড়ে ওঠার খুব শখ ছিল, পারিনি। শেষমেষ দেখি, গল্প-কবিতা লিখতে লিখতে লেখকই হয়ে উঠেছি!
লেখালেখির জন্য প্রথমত ভাষাগত প্রস্তুতি থাকা খুব দরকার বলে আমার মনে হয়। আর ভাষাগত প্রস্তুতি গড়ে ওঠে মহৎ সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষায় লিখতে হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়া যেমন আবশ্যক তেমনি অন্য ভাষার মহৎ সাহিত্যিকদের লেখাও পাঠ করতে হবে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করতেন, যদি আজকের দিনই হয় আমার জীবনের শেষ দিন, তাহলে আমার কোন কাজটি সবার আগে করা উচিত? একজন লেখকও এ রকমভাবে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেন শব্দে শব্দে—কী লিখতে চান তিনি, কীভাবে লিখতে চান, কী কথাই বা বলতে চান? অমর একুশে বইমেলার বই-গন্ধ গায়ে মেখে তোমরা যারা লেখক হওয়ার পথ খুঁজছ, যারা স্বপ্ন দেখছ ভবিষ্যতের লেখক হওয়ার, তারা তো জানোই শব্দে শব্দে মিল-অমিল দিয়ে লেখক হওয়া এত সহজ কম্ম নয়। এর জন্যও লাগে দীর্ঘ প্রস্তুতি, পড়াশোনা। তোমাদের জন্য দেশের তিন খ্যাতিমান লেখক এবার জানাচ্ছেন কেন লেখক হলেন তাঁরা, কীভাবে লেখক হলেন—অভিজ্ঞতার আদ্যপান্ত।
হাসান আজিজুল হক
লিখতে হলে পড়তে হবে—তরুণ লেখকদের প্রতি প্রথমত এটিই আমার বলার কথা। মনে রাখতে হবে, লেখকের পথ বড়ই বিপদসংকুল। এটা সম্পূর্ণ একার পথ। কঠিন এক সাধনা। কোনো লেখকের পক্ষে কি বলা সম্ভব, তিনি কেন লেখক হয়েছেন? মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, লেখক না হয়ে উপায় ছিল না বলেই শেষ পর্যন্ত লেখক হয়েছি। খুব ছোটবেলা থেকে কেন যে কবিতা, গল্প—এসব লিখতাম, আজ সেটা স্মৃতি খুঁড়ে বের করা কঠিন। বলা যায়, যে পৃথিবীতে বেঁচে আছি সেই পৃথিবীর একটা অর্থ ও ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারি লেখার মাধ্যমে। এটি হয়তো প্রত্যেক লেখকই পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে একজন লেখকের সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট একটা ধারণা থাকা জরুরি। লেখক হতে চাইলে তুমি যা কিছু করতে চাও, তার সবই তোমাকে লেখার ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত করতে হবে। ব্যক্তি ভেদে একেকজন লেখকের লেখার কৌশল একেক রকম। আমি যেমন সাধারণত একটি লেখা একবারেই লিখে ফেলি। কিন্তু লেখাটি লেখার আগে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা থাকে বিস্তর। কীভাবে আগের লেখা থেকে নতুন লেখাকে আলাদা করা যায়—এই ভাবনাও থাকে। আমি মনে করি, প্রত্যেক লেখকই তাঁর নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেন একান্ত তাঁর মতো করে।
মহাদেব সাহা
আমি কি কবি হতে পেরেছি? জানি না। মনে পড়ে, ১৯৭৬ সালে প্রেসক্লাব-সংলগ্ন ফুটপাতের ওপর বসে একটানে লিখেছিলাম ‘চিঠি দিও’ কবিতাটি। পরে সেটি প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়। শৈশবে আমার মা বিরাজমোহিনির মুখে রামায়ণ ও মহাভারত শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তখন মনে হতো, বাল্মীকি বা ব্যাসদেবের মতো যদি কবি হতে পারতাম!
একটি শব্দের জন্য বসে থেকেছি সারা রাত। জীবনানন্দ দাশ কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা পড়েছি উন্মাদের মতো। পড়েছি জন কিটস, রাইনার মারিয়া রিলকে, ডব্লিউ বি ইয়েটস। পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে হয়তো কবি হয়ে উঠেছি আমি। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে কবি হচ্ছে একমাত্র অবিনাশী সত্তা—রাজা, সম্রাট তাঁর কাছে কিছু নয়। তাই কবি বা লেখক হতে গেলে যেমন পড়াশোনা জরুরি, তেমনি দরকার লেখকের স্বাধীন সত্তা। কারও পরামর্শ নিয়ে কেউ কোনো দিন কবি হতে পারে না।
অদিতি ফাল্গুনী
যদি মেয়ে না হতাম, তাহলে আমি হয়তো কখনোই লেখক হতাম না। কথাটি খোলাসা করি—মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী সংকুচিত হয়েছে। সেই শৈশব উত্তীর্ণকালে আমার বয়সী বন্ধুগোত্রীয় ছেলেরা যেভাবে পৃথিবীকে দেখেছে, আমার দেখা ছিল তাঁদের থেকে ভিন্ন। শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী যে ছোট হয়ে এল, এই বেদনাবোধই আমাকে লেখক করে তুলেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, প্রতিকূলতা অনেক সময় আমাদের ভেতরের আগুনকে উসকে দেয়।
আমাদের বাড়িতে বড় একটি পাঠাগার ছিল। সেখানে ছিল রুশ সাহিত্যসহ নানা ধরনের বই। এ ছাড়া কলেজের গ্রন্থাগারে পড়েছি গ্রিক নাটক। এই পাঠ আমাকে পুষ্টি দিয়েছে। একসময় পাহাড়ে ওঠার খুব শখ ছিল, পারিনি। শেষমেষ দেখি, গল্প-কবিতা লিখতে লিখতে লেখকই হয়ে উঠেছি!
লেখালেখির জন্য প্রথমত ভাষাগত প্রস্তুতি থাকা খুব দরকার বলে আমার মনে হয়। আর ভাষাগত প্রস্তুতি গড়ে ওঠে মহৎ সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষায় লিখতে হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়া যেমন আবশ্যক তেমনি অন্য ভাষার মহৎ সাহিত্যিকদের লেখাও পাঠ করতে হবে।